পিতৃপক্ষের শেষক্ষণ ও মাতৃপক্ষের সূচনাকালের সময়কেই মহালয়া বলা হয়। মহান কিংবা মহত্বের আলয় (আশ্রয়) থেকেই এই শব্দের উৎপত্তি। সনাতন ধর্ম অনুযায়ী, এই দিনে প্রয়াত আত্মাদের মর্ত্যে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, প্রয়াত আত্মার যে সমাবেশ হয় তাকেই মহালয় বলা হয়ে থাকে। যদিও এই নামের একাধিক অর্থ হয়েছে। পুরাণ, শাস্ত্র ও আভিধানিক ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ দেখা যায়।
পিতৃপক্ষের এক পক্ষকাল পিতৃপুরুষরা মনুষ্যলোকের কাছাকাছি চলে আসে। পুরাণমতে, ব্রহ্মার নির্দেশেই গড়ে ওঠে এই মহামিলনক্ষেত্রটি। এই সময় তাই পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ করে মানুষ। শাস্ত্রমতে, হিন্দুদের অবশ্য পালনীয় যে পঞ্চমহাযজ্ঞের বিধান রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হল পিতৃযজ্ঞ অর্থাৎ তর্পণাদি। এই তর্পণ কথার অর্থ হল, যাতে অন্যের তৃপ্তি হয় সেই উদ্দেশ্যে জলদান। তর্পণ তাই শুধু পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যেই নয়, সর্বভূতের উদ্দেশেই করতে হয়। তর্পণের মন্ত্রের ভিতরই নিহিত রয়েছে সেই নির্দেশ-
আব্রহ্মস্তম্বপর্যন্তং দেবর্ষিপিতৃমানবাঃ।
তৃপ্যন্ত পিতরঃ সর্বে মাতৃমাতামহোদয়ঃ।।
আব্রহ্মস্তম্বপর্যন্তং জগৎ তৃপ্যতু।
অর্থাৎ, দেবগণ, ঋষিগণ, পিতৃগণ, নরগণ – ব্রহ্মা হইতে তৃণশিখা পর্যন্ত সমস্ত জগৎ আমা কর্তৃক প্রদত্ত অন্নজলে তৃপ্তিলাভ করুন। এই হল তর্পণের গূঢ় কথা। শাস্ত্র বলে, সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম- অর্থাৎ, সমস্ত জগৎ ব্রহ্মময়। তাই জলদান করতে হয় সর্বভূতের উদ্দেশ্যেই। যেহেতু পিতৃপক্ষে পিতৃলোক ও মনুষ্যলোক কাছাকাছি চলে আসে, তাই ধারণা করা হয়, এই সময়কালে যদি পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ অর্থাৎ জলদান করা হয়, তবে তা তাঁদের কাছে সহজে পৌঁছায়। যার মহাপ্রকাশ পিতৃপক্ষের শেষ দিনটিতে অর্থাৎ মহালয়ায়। এই কারণেই পিতৃপক্ষের অবসানে মানুষ তর্পণে রত হন। মহালয়ার এক অর্থ যে পিতৃলোক, তা এই ধারণা থেকেই উঠে এসেছে। একই সঙ্গে পিতৃপক্ষের অবসানে, দেবীপক্ষের সূচনাও যেহেতু চিহ্নিত হয়, তাই মহালয়া অর্থে মা দুর্গাকেই আশ্রয় ধরা হয়। শাস্ত্রে কথিত আছে, এই দিনেই মহিষাসুর বধের দায়িত্ব গ্রহণ করেন দেবী দুর্গা। মহিষাসুরের কবল থেকে দেবগণকে উদ্ধার করার লগ্ন যেহেতু এখান থেকেই সূচিত হচ্ছে, তাই পরমা প্রকৃতি বিশ্বজননীর আশ্রয়ই হল মহান আলয়, এমত মত পোষণ করেন অনেকে।
মহালয়া শুভ না অশুভ, এ নিয়েও তর্ক কম নেই। কেউ কেউ বলে থাকেন, এই দিনটি শুভ নয়। যেহেতু এইদিন পিতৃপুরুষের স্মরণ করা হয়, তাই প্রকৃতপক্ষে এ আসলে শোকের দিন। দিনটিকে সেহেতু শুভ বলে চিহ্নিত করা সঙ্গত নয়। মতান্তরে, হিন্দু শাস্ত্রে যে কোনও শুভ কাজের সূচনাতেই পিতৃপুরুষকে স্মরণ বা তর্পণ করা হয়। যে রীতি হিন্দুর নিত্য পঞ্চমহাযজ্ঞের অন্তর্গত, তাকে অশুভ বলাও বাঞ্ছনীয় নয়। যদি তর্পণের বৃহত্তর অর্থটি ধরতে হয়, তা আসলে ইঙ্গিত দেয় জগৎব্যাপী এক মহামিলনক্ষেত্রের। মিলনের এই মুহূর্ত এবং তার উৎযাপন তাই কোনোভাবেই অশুভ হতে পারে না।
মহালয়ার দিনের গুরুত্ব অনেকটাই। বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা মতে মহালয়ার পর প্রতিপদে যে বোধন হয় সে সময়ও সংকল্প করে দুর্গা পূজা করা যায়।যাকে বলে প্রতিপদ কল্পরম্ভা। মহাভারতের পাশাপাশি মহালয়ার ক্ষণের উল্লেখ পাওয়া যায় কৃত্তিবাসী রামায়ণেও। সেখানে লঙ্কা বিজয়ের আগে অকালে দেবীকে এই সন্ধিক্ষণে আরাধনা করেছিলেন শ্রী রামচন্দ্র। পরবর্তীতে যা বাসন্তী পুজো নামেই সর্বজনবিদিত। পুরাণ, শাস্ত্র, ইতিহাস বলে যে আলয়ে অন্ধকার ক্ষণ লয় হয়ে আলোকে উদ্ভাসিত হয়, সেই সময়ের গুরুত্ব অসীম হওয়াই স্বাভাবিক।